এইতো মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, করোনার চেয়েও এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিষ্ট্যান্স আগামীতে আরও ধ্বংসাত্মক হবে।
ব্লগের প্রথম পাতাতে দেখলুম আমি সাজিদ এ বিষয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন আজকে। এটা দেখে তার পোস্টে মন্তব্য করতে যেয়ে মনে হলো , আরে! আমার নিজেরই তো একটা লেখা আছে পর্ব করে এই ব্লগে। আমি সাজিদ এর পোস্টের সম্পুরক হবে ভেবে সে লেখাটাই এখানে রি-পোস্ট করলুম সবাই যেন বিষয়টির গভীরতা অনুভব করতে পারেন।
সব লিংক -
এন্টিবায়োটিকের কথা। প্রথম পর্ব
এন্টিবায়োটিকের কথা। দ্বিতীয় পর্ব
এন্টিবায়োটিকের কথা। শেষ পর্ব
[ শুরুর পর্ব ]
২০১৯ সালের কোনও একসময় বাংলাদেশ হাইকোর্ট রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যাখ্যা করতে বলেছেন, কেন রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রয় বেআইনি বা অবৈধ ঘোষনা করা হবেনা।
কঠিন কঠিন রোগের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে এ নিষেধাজ্ঞাটি অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। হাইকোর্টকে এ জন্যে ধন্যবাদ দেয়া যেতেই পারে। কারন বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান “এন্টিবায়োটিক রেসিষ্ট্যান্স” বা এন্টিবায়োটিক নামের ঔষধগুলির অকেজো হয়ে যাওয়ার ঘটনায় ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশান থেকে শুরু করে ইউনিসেফ পর্যন্ত আতঙ্ক প্রকাশ করে সাবধানবাণী দিয়েছেন এই বলে, “The world is running out of antibiotics...”। তারা বলছেন, অনুজীব ধংসকারী( এন্টিমাইক্রোবিয়ালস) ঔষধের যথেচ্ছ আর অপব্যবহারের কারনে যক্ষা, নিউমোনিয়া সহ মূত্রতন্ত্রের রোগ, খাদ্যের বিষক্রিয়া, যৌনরোগ, পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ, হাসপাতাল থেকে সংক্রমিত রোগ ইত্যাদি জীবন সংহারী রোগগুলোর বিরূদ্ধে মানুষের হাতের অস্ত্র মানে এন্টিমাইক্রোবিয়ালসগুলো দিনে দিনে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। যে হারে অনুজীবগুলি বিশেষ করে ব্যাকটেরীয়া মানুষের তৈরী অস্ত্রগুলোর বিরূদ্ধে প্রতিরোধ ( রেসিষ্ট্যান্স) গড়ে তুলতে লেগেছে তাতে অচিরেই মানুষের অস্ত্রভান্ডারে টান ধরবে। টান ধরবে না-ই বা কেন? নতুন নতুন ঔষধ আবিষ্কারে গবেষণার কাজে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচের কথা না হয় বাদই দিলুম কিন্তু এক একটি নতুন এন্টিমাইক্রোবিয়াল তথা এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারে যে বছরের পর বছর লেগে যাচ্ছে, তা অতিক্রম করবে মানুষ কিভাবে ?
“বাঁচতে হলে লড়তে হবে” এই সূত্র ধরে ক্ষুদে ক্ষুদে অনুজীবগুলোই এখন মানুষকে প্রতি নিয়ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। মানুষ পড়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে। যে হারে অনুজীবগুলো তাদের বিরূদ্ধে ব্যবহৃত ঔষধগুলোর প্রতি রেসিষ্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে ততো দ্রুত কিন্তু মানুষ নতুন নতুন ঔষধ নামক অস্ত্র সরবরাহ করতে ব্যর্থ। অনুজীবগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষ “সময়” নামের ফ্যাক্টরটিকে কব্জা করতে পারছেনা কিছুতেই। তাই ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশান, ইউনিসেফ চিকিৎসক সমাজের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, তারা যেন অযথা ও যথেচ্ছভাবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করেন এবং সর্বশেষ আবিষ্কৃত এন্টিবায়োটিকগুলির প্রয়োগে সতর্ক থাকেন। কারন যথেচ্ছ ব্যবহারে হাতের এই পাঁচও যদি অকেজো হয়ে যায় তবে আগামী দিনগুলোতে কঠিন কঠিন রোগগুলো থেকে মানুষকে আর বাঁচিয়ে আনা সম্ভব হবেনা। চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি সহ বাড়বে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে ভালো হওয়ার অপেক্ষায় গোনা দিন, বাড়বে মৃত্যুহার।
মানুষ, পশু আর কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই রেসিষ্ট্যান্ট হয়ে ওঠে বটে কিন্তু এন্টিবায়োটিকগুলোর যত্রতত্র -অযথা -অপর্যাপ্ত -অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এই রেসিষ্ট্যান্ট হয়ে ওঠার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে শতগুন।
এর প্রমান তো আমরা পেয়েছি অতি সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদে যে, দেশের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রগুলিতে (আই-সি-ইউ) ৮০% মৃত্যই হয়ে থাকে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকগুলো অতিমাত্রায় রেসিষ্ট্যান্ট হয়ে যাওয়ার কারনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির (BSMMU) ফার্মাকোলজী বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন এই তথ্যটি।
যে দেশের এক তৃতীয়াংশ রোগীই যেখানে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এন্টিবায়োটিক খেয়ে থাকেন. যে দেশের মানুষ শারীরিক কিছু অস্বস্তি বোধ করলেই নিজে নিজেই এন্টিবায়োটিক কিনে এনে ব্যবহার করেন, সে দেশে এমনটি যে হবে তা জানা কথা-ই! তাই হাইকোর্ট সচেতন হয়েই প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন। সাধু!
কিন্তু দেশীয় প্রেক্ষাপটে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা কতোটা যৌক্তিক? এর দ্বারা কতোটুকু বা অর্জন করা সম্ভব হবে? এখনও এদেশে ১৮৪৭ জনের জন্যে রয়েছেন মাত্র ১জন চিকিৎসক (বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল কর্তৃক রেজিষ্ট্রিকৃত)। আর সরকারী চিকিৎসক রয়েছেন ৬৫৭৯ জনের জন্যে সর্বসাকুল্যে ১জন। হিসেবটি ২০১৮সালের।এখন হয়তো এই অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে যেহেতু বর্তমান সরকার স্বাস্থ্যখাতে প্রচন্ড মনযোগী, আমরা দেখতে পাচ্ছি। সরকারী চিকিৎসা যারা নিচ্ছেন তারা হয়তো নিষেধাজ্ঞাটি কার্যকর হলে এন্টিবায়োটিকের অযথা বা যথেচ্ছ ব্যবহার থেকে রেহাই পাবেন কিন্তু বিপুল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা সরকারী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে যান না, কিম্বা এড়িয়ে চলেন তারা তো নির্ভর করে থাকেন গ্রাম্য হাতুড়ে চিকিৎসকদের অথবা নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন, তাদের কি হবে? এদেরও তো কোনও কোনও সময় একটি এন্টিবায়োটিক জীবন বাঁচাতে জরুরী হয়ে পড়তে পারে! আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফার্মেসীগুলোতেও প্রায় সব এন্টিবায়োটিকই সহজলভ্য। এর ব্যবহার ঠেকানোই বা যাবে কি করে? দু’পয়সা রোজগারের আশায় বসে থাকা ঐ সব হাতুড়ে চিকিৎসক বা ঔষধ বিক্রয়কারী মানুষগুলো কি এই সব হিতোপদেশ শুনবেন? অর্থের সাথে সম্পর্কিত এই বিষয়টি তাই মনে হয় বেশ নাজুক অবস্থায় ফেলে দেবে আমাদেরকে।
আমার তো মনে হয়, সরকার মোটিভেশান প্রোগ্রাম ও প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে এন্টিবায়োটিকের বেহুদা ও যথেচ্ছ ব্যবহারে স্বাস্থ্য ঝুঁকি- মরনঘাতী প্রতিক্রিয়া-চিকিৎসা বিভ্রাট-চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি সহ অন্যান্য কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে পারলেই এন্টিবায়োটিকের অহেতুক ব্যবহার অনেকটা কমে আসতে পারে। সরকারের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোই এ জাতীয় প্রচার চালাতে পারেন।
এন্টিবায়োটিকের কার্যাবলী, অনুজীব তথা ব্যাকটেরীয়াদের কর্ম-বৃত্তান্ত, তাদের রেসিষ্ট্যান্ট হয়ে ওঠার প্রনালী ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু সাধারন জ্ঞান থাকলেই আমরাও বুঝতে পারবো কেন কোনও এন্টিবায়োটিকের সাহায্য ছাড়াই আপনা আপনি বেশীর ভাগ রোগই ভালো হয়ে যায়। তা হলেই কেন - কখন - কিভাবে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার করতে হবে বুঝতে পারবো তা-ও! বুঝতে পারবো আমি নিজে সুরক্ষিত কিনা, দেশের বৃহত্তর জনমানুষের সুরক্ষায় আমি কোনও অবদান রাখতে পেরেছি কিনা!
শেষক্রমণিকা -
২৫ শে এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৫:২১ টায় ব্লগার “সত্যপথিক শাইয়্যান” এর পোস্ট “প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক ব্যবহার/বিক্রি করা যাবে না - হাই কোর্ট” য়ে শেষ লাইন দু’টির প্রেক্ষিতে আমার এই লেখা।
হাই কোর্টের এই রায়টি নিয়ে ব্লগে তেমন আলোচনা দেখিনি। মনে হয় আমরা এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে সম্ভবত চিন্তিত নই কারন এ সব বিষয়ে আমাদের জানার আগ্রহ বা পরিধি হয়তো কম। কিন্তু এটাই আগামীতে এক ভয়াবহ দূর্যোগ ডেকে আনতে পারে।
তাই এখানেই শেষ নয়- আসছি এন্টিবায়োটিকের কথা নিয়ে।
সুত্র : Click This Link
https://www.who.int/en/news-room/fact-sheets/detail/antibiotic-resistance
bdnews24.com
https://thefinancialexpress.com.bd/health/bangladesh-has-one-doctor-for-every-1847-people-1519053209
ছবির কৃতজ্ঞতা : “ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ” এর কাছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২১ সকাল ১০:২৭